৩৬ জুলাই বিপ্লবের কথা 

৫ই আগস্ট, (সোমবার ) ছাত্ররা এখনো বলছে, আজ ৩৬ জুলাই। ছাত্রদের রক্তে এখনো ভেঁজা ঢাকার রাজপথ। অনবরত চলছে গুলি। ক্ষণে ক্ষণে মরছে মানুষ। চারিদিকে হাহাকার আর বেদনার অশ্রুবারী। এ কি সেই স্বাধীন বাংলা। ৭১ এ ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আনা হয়েছিল যে  স্বাধীনতা। রাস্তায় তখন অনেক মানুষ। সবার মাথায় দেশের পতাকা। স্লোগানে মুখরিত সমস্ত এলাকা। মোড়ে মোড়ে স্বৈরাচারীর হায়নাবাহিণীরা। নেমেছে সেনাবাহিনীও। সশস্ত্র বাহিনী লক্ষ্য রাখছে আন্দোলনের গতি ধারা। পরিস্থিতি থম থমে কি যেন হবে। নতুন কোনো পূর্বাভাস নেই কিন্তু বাংলার বাতাসের এখনো রক্তের গন্ধ। লাশের স্তূপ পড়েছে ঢাকাতে। যাত্রাবাড়ীতে চলছে হায়নাবাহিনীদের কিলিং মিশন। কেউ জানে না, কি হবে এর শেষ টা। নয় দফা দাবির শেষ পরিণাম হলো এক দফা দাবি। ” সরকারের পদত্যাগ ” এখন ছাত্রদের মুখ্যম দাবি। স্বৈরাচারী সরকারের বর্বরতা থেকে কেউ রেহায় পায় নি। হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া গুলি থেকে শুরু করে ১ মিটার দূরত্ব থেকেও গুলি খেয়েছে বহু মানুষ। শিশু থেকে বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী থেকে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হয় নিহত নাহয় আহত হয়েছে। স্বাধীন বাংলার সংবিধান অনুযায়ী, যুদ্ধপরাধীর হাঁটুর নিচ পর্যন্ত গুলি করার অধিকার রয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর। কিন্তু সেই গুলি কেন চলছে, নিরীহ মানুষের বুকে। কেন সেই গুলি কেড়ে নিচ্ছে রাষ্ট্রের সোনালী ভবিষ্যৎ কে। উত্তর কারর জানা নেই। সবাই হন্ন হয়ে খুঁজছে, নতুন সূর্যের আলো। কিন্তু অন্ধকারছন্ন এই দেশে কি করে সকলে দেখবে সেই সূর্য। স্বৈরাচারী সরকার শক্তিশালী হাতে বার বার আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বীর বাঙালি ছাত্র জনতা কোনোমতেই পিছু হটবে না। একে একে যোগ দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। আন্দোলন আরো জোরদার হচ্ছে। ঘরে ঘরে তখন বীরের জন্ম, এদের মধ্যেই এক বীর শহীদ আনাস। ১০ ম শ্রেণির ছাত্র। বয়স মাত্র ১৭। 

সকাল তখন ৮ টা, আনাস চিঠি লিখেছে। চিঠিতে বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বাবা মার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে বের হয়েছে আন্দোলনের উদ্দেশ্যে। আন্দোলন তখন আরও প্রখর হয়ে উঠেছে। ১১ টা বেজে ১৮ মিনিট ; চাংখারপুল, শেখ হাসিনা বার্ন এন্ড সার্জারী ইনস্টিটিউটের সামনে গুলিবিদ্ধ হলো আনাস। পরপর তিনটা গুলি। বুকে লাগলো ২ টা আর মাথায় ১ টা। মাথা আর বুকের লাল সবুজের পতাকা সাক্ষ্য দিচ্ছে রক্তের বহমান স্রোতের। চারিদিকের মানুষ নিয়ে গেল, হাসপাতালে। এই পরিস্থিতিতেও চলছে গুলির বর্ষণ। কোনো রকমে হাসপাতালে পৌঁছালেও ততক্ষণে আনাস সকলকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে। এভাবেই শহীদ হয়েছে বহু মানুষ। তবুও জীবন উৎসর্গ করে তারা শুধুই চেয়েছে  জনগণের বাক স্বাধীনতা আর প্রাপ্য অধিকার। শহীদের কাছে স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি তাই তো তারা পেরেছে, জীবনের মায়া ত্যাগ করে হলেও অধিকারের জন্য লড়তে। আজ জনগণের মুখে অগ্নি বাণী। তাদের জন্যই। কারণ তারাই মৌন মলিন মুখে ভাষার সঞ্চার ঘটিয়েছে। তাদের জাতি চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।  ইতিমধ্যে, জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছে সেনা প্রধান। জানা হলো রাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতি। শাহবাগে নেমেছে আনন্দ মিছিল। সবার মনে এক নতুন স্বাধীনতার উল্লাস। বাংলার বাতাসে উড়ছে স্বাধীন বাংলার পতাকা। কি আনন্দ!  কিন্তু পরক্ষণেই আবার দুঃখের সাগরে ডুব দিচ্ছে জাতি। কি যন্ত্রণা স্বজন হারানোর। কি বেদনা সন্তান খোয়ানোর। এরই প্রেক্ষাপটে ৬ই আগস্ট, রোজ মঙ্গলবার। সেন্টার ফর এইড। প্রতিষ্ঠা কাল ২০২৩। অল্প কিছু সদস্যের একটি সেচ্ছাসেবী দল। সকলে মিলে পরিকল্পনা করছে, রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে কীভাবে দায়িত্ব বন্টন করা যায়। ফাউন্ডার লোহান আলম আর সহকর্মী ফাতেমা জান্নাতের সমন্বয়ে শুরু হলো শহীদ আনাসের স্মরণে গ্রাফিতি। গেন্ডারিয়া ঢাকার শহীদ স্মরণীয় প্রথম দেয়ালচিত্র আঁকার সূচনা  হলো সেন্টার ফর এইডের হাত ধরেই। কাজ তখন শুরু মাত্র, একে একে মানুষ আসছে। মুখে নানা প্রশ্নের সমাহার। কেউবা আসছেন কাজ দেখতে নয়তো সাহায্য করতে। আঁকা – আঁকি আর খানিকটা রঙের ছোঁয়ায় কেটে গেল প্রথম দিন। দ্বিতীয় দিনটা বেশ সুন্দর। চারিদিকে অনেক মানুষ, সকলে এসেছে সাহায্য করতে। অনেকে খাবার – দাবারও কিনে দিয়ে যাচ্ছেন নয়তো বাড়ি থেকে নিয়ে আসছেন। অসম্ভব সুন্দর এক প্রশান্তি। মাথার উপর সূর্য টা খুব উজ্জ্বল। কিন্তু তাতে কষ্ট নেই। পথচারীদের মধ্যে অনেকে ব্যস্ততা ছেড়ে ছাতা ধরেছে। সত্যিই কি চমৎকার দৃশ্য। রঙ করা শেষ হয়ে গেলেও এখনও প্রয়োজন রঙের নিখুঁত ছোঁয়া। বাকি কাজ টা আগামীকালের জন্য উৎসর্গ করে তৃতীয় দিনের অপেক্ষা। সেদিন তৃতীয় দিন, বলা যায় শেষ দিবস।  দেয়ালচিত্রের শেষ প্রান্তে নিখুঁত রঙের ছোঁয়া প্রায়ই শেষ। ততক্ষণে বহু মানুষ ভিড় করেছে। অনেকে দোয়াও দিচ্ছেন। সকলের মুখের হাসি আর শুভকামনা গুলো বারংবার জানান দিচ্ছে, সেন্টার ফর এইড আজ স্বার্থক।    ক্ষুদ্র প্রয়াসের ছোট্ট সেই সেন্টার ফর এইড, আজ অসংখ্য সদস্যের দলে রূপান্তরিত হয়েছে। অপার সৌন্দর্যে বিচরিত সিএফএ।  ইতিমধ্যে রঙ করা শেষ। দেখতে এসেছেন শহীদের পরিবার। স্মৃতিমালা আজ বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে, প্রিয় সন্তান আজ নেই মাঝে। অথচ এই রাস্তায় প্রথম গুটি গুটি পায়ে সে হাঁটতে বের হয়েছিল। জীবনের ভূমিকা লগ্নের কত দিন এ পথ ধরে হেঁটেছে আনাস।  কত আপন স্মৃতি স্বাক্ষর করে রেখে গেছে সে। স্বজনরা অশ্রুশিক্ত নয়নে বর্ণনা করছেন সন্তানের প্রতি অকৃত্রিম সেই ভালোবাসা। শহীদ আনাসের প্রতি এই সম্মান এবং তার স্মরণে করণীয় সবকিছুর জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন শহীদ আনাসের পরিবার। সত্যিই তারা কৃতজ্ঞ। জীবন বাজি রেখে যারা দেশের জন্য, অধিকারের জন্য লড়তে গিয়ে নিজের সর্বস্ব হারিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন তাদের পাশে সর্বক্ষণ সেন্টার ফর এইড রয়েছে। জনগণের সাথে সেন্টার ফর এইড সর্বদাই এগিয়ে এসেছে এবং সর্বক্ষণ নিয়োজিত রয়েছে। ২০২৩ থেকে ২০২৪, মাঝে ছোট ছোট অনেক গল্প কিন্তু জনগণের সেবায় সেন্টার ফর এইড যেই ভালোবাসা এবং যত্ন পেয়েছে তা সর্বদাই সেন্টার ফর এইডকে প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। সকলের দোয়া এবং শুভ কামনা কাম্য করে সেন্টার ফর এইড এগিয়ে চলেছে দূর দূরান্তের পথে।

কলমে: লামিয়া আমিন সংমি, হেড অফ কন্টেন্ট রাইটিং, সেন্টার ফর এইড। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *