বিল দখলের মহা উৎসব, থামছেই না ফসলি জমির ধ্বংসযজ্ঞ! 

মাজিদুল ইসলাম উজ্জ্বল,

রাজশাহীর পুঠিয়া থানার বিভিন্ন গ্রামে কয়েক শত বিঘা আবাদি জমি চলে গেছে পুকুরের  পেটে। এসব ফসলি জমি বিনাশ করে তৈরি হয়েছে বড় বড় পুকুর। গ্রামের সহজ সরল কৃষকদের কখনো অতিরিক্ত অর্থের লোভ দেখিয়ে, কখনো আবার ভয় ভীতি দেখিয়ে ইজারা নেওয়া হয়েছে জমি গুলো। একটি প্রভাবশালী চক্র রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় কৃত্রিমভাবে মাছ চাষ করে অধিক মুনাফার লোভে খনন করেছে এসব পুকুর। 

পুঠিয়া উপজেলার শীলমাড়িয়া, সাতবাড়িয়া, রাঙ্গামাটিয়া, হাড়োগাথী, দনোকুড়ি, বিলমাড়িয়া সহ প্রায় গ্রামেই দেখা যায় কিভাবে শত শত বিঘা ফসলি জমি কেটে তৈরি হয়েছে এসব পুকুর। এসব কৃত্রিম পুকুর গুলো আবার টিকে আছে ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভর করে। তাই এসব এলাকায় অবশিষ্ট ফসলি জমি গুলোও গ্রীষ্মকালে তীব্র খরায় পতিত হচ্ছে। পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ( ওয়ারপো) জানায়, তিন বছরে পানির স্তর রাজশাহী শহরে ২৪ ফুট এবং গ্রামে ২০ থেকে ৩৫ ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে। এর প্রভাবে ফসলের আশানুরুপ ফলন পাচ্ছে না গ্রামের কৃষকগণ। বারবার ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে তারাও কৃষি কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তাই তারাও জিম্মি হয়ে পড়ছে পুকুর খননের সিন্ডিকেটের কাছে। এর ফলে অবশিষ্ট ফসলি জমি গুলোও ধীরে ধীরে পুকুরের পেটে চলে যাচ্ছে। 

মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে পুরো জেলায় মাছের খামারের পরিমাণ ছিল ৩,৪০২ হেক্টর। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০২২ সালে এর পরিমাণ  দাঁড়ায় ২৫,৩০৯ হেক্টর। এখান থেকেই বোঝা যায় কি পরিমান ফসলের জমি চলে গেছে পুকুরের পেটে। এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি অর্থনীতিতেও মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। বিলের ধানি জমি ধ্বংস হওয়ায় ধানের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ২০১৯ সালের ৬০০ টাকা মনের ধান বর্তমানে ১৪০০ ছুঁয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে যে ধানের দাম আরো বাড়বে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 

পুঠিয়ার  হাড়োগাথী গ্রামের বড় দুটি বিল (কাইরার বিল ও ডোবার বিল) এখানকার মানুষের প্রাকৃতিক মাছের প্রধান উৎস। দীর্ঘ এক খালের মাধ্যমে বিল দুটি সংযুক্ত আছে রানী নদীর সাথে। কয়েকটি গ্রামের  পানি নিষ্কাশিত হতো এই বিলের মাধ্যমে। কিন্তু কাইরার বিলটি খনন করে বানানো হয়েছে পুকুর। এখন তার পাশের জমিগুলোও চাষের অনুপযোগী  হয়ে যাওয়ায় সেগুলোও চলে যাচ্ছে পুকুরের মধ্যে। মাত্র কিছুদিন আগেই ডোবার বিলেও অবৈধভাবে খনন কাজ করা হয়েছে। এই বিলের চারপাশে উঁচু পাড় বাঁধায় বাজার সংলগ্ন কালভার্ট এবং অপর প্রান্তে অবস্থিত উঁচু ব্রীজটি অকেজো হয়ে যাওয়ার উপক্রম। সবুজ উর্বর ধানের জমির বুক চিরে চালানো হয় ভেকু মেশিন আর তোলা হয় ট্রাক-ট্রাক মাটি। স্থানীয় জনগণের বাধা উপেক্ষা করেই ততকালীন আওয়ামী লীগ নেতার প্রভাবে খনন করা হয়েছে বিশাল পুকুর।  অথচ কৃষি জমির সুরক্ষা আইনে বলা হয়েছে, কোনভাবেই কৃষি জমির শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না। পবা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নুরুল হাই মোহাম্মদ আনাস বলেন, আইন অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বে সরকারি  স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকার সর্বনিম্ন ১ কিলোমিটার এর মধ্যে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। 

এখানে উত্তোলনকৃত মাটির বেশিরভাগই বিক্রি হয় স্থানীয় ইটভাটায় এবং প্রাকৃতিক জলাশয় সমূহ ভরাট করতে। অথচ কৃষি জমি কেটে ইট বানানো এবং প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট উভয়ই  আইনত নিষিদ্ধ।  সুতরাং দেখা যাচ্ছে কৃষি জমি কেটে পুকুর খননের পুরো কার্যক্রমই সম্পূর্ণ অবৈধ  এবং আইন পরিপন্থী কাজে জর্জরিত। কাজ শুরুর প্রথমে প্রশাসনের বাধায় কিছুদিন বন্ধ রাখা হয়েছিল খনন কাজ। তারপর রাতের আঁধারে করা হয় ফসলি জমির এই ধ্বংসযজ্ঞ। এই পুকুরটি হয়ে যাওয়ায় এর চারপাশের অবশিষ্ট জমিগুলো গ্রীষ্মকালে পতিত হচ্ছে তীব্র খরায় এবং বর্ষাকালে সৃষ্টি হচ্ছে জলবদ্ধতার। এছাড়াও আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের পানি নিষ্কাশনের আর কোন উপায় থাকবে না। 

এই বিলের একজন জমির মালিক সেলিম রেজা বলেন, এখানকার বেশিরভাগ জমি তাদের দখলে চলে যাওয়ায় অবশিষ্ট জমিগুলো  বেকায়দায় পড়ে গেছে। তাই কয়েকজন জমির মালিক নিরুপায় হয়ে তাদের চুক্তি মেনে নিয়েছে। বিলের মাঝখানে রয়েছে আমার জমি। আমি কিছুতেই তাদেরকে জমি দিতে রাজি হইনি। কিন্তু চারপাশে তারা পুকুর বানিয়ে  আমার জমিতে যাওয়ার বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। তাই আমিও আর কোন উপায় দেখছি না। 

এভাবেই কৃষকের ইচ্ছায়  বা অনিচ্ছায় গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ ফসলের জমি চলে যাচ্ছে পুকুর খননকারী প্রভাবশালী মহলের হাতে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় ও দেশের খাদ্যের আমদানি নির্ভরতা কমাতে ফসলি জমি রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেবে সরকার,  এমনটাই প্রত্যাশা সচেতন নাগরিক সমাজের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *